লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ কি? অধিবর্ষ কেন হয়? বিস্তারিত ইতিহাস

লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ হলো ৪ দ্বারা বিভাজ্য সাল। ২০২৪ সাল একটি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ সাল। অর্থাৎ এই বছর আটাশ দিনের পরিবর্তে ফেব্রুয়ারি মাস হবে ২৯ দিনে। একটি বছর একটি অধিবর্ষ কিনা তা পরীক্ষা করতে, বছরটিকে ৪ দ্বারা ভাগ করুন। যদি এটি ৪ দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিভাজ্য হয় তবে এটি একটি অধিবর্ষ । উদাহরণস্বরূপ, ২০১৬ সাল ৪ দ্বারা বিভাজ্য, তাই এটি একটি অধিবর্ষ সাল।  কিন্তু কেন? কীভাবে এবং কখন থেকে এই বাড়তি দিন গণনা শুরু হলো?

 

লিপ ইয়ার কি?

লিপ ইয়ার হচ্ছে একটি বিশেষ বছর, যাতে অন্যান্য সাধারণ বছরের তুলনায় একদিন বেশি থাকে। অর্থাৎ দিন সংখ্যা ৩৬৬ দিন হলে সেটাকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ বলে। আর এই একটা দিন বেশি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০২০ সাল ছিল অধিবর্ষ। এরপর ৪ বছরে ৬ ঘণ্টা করে বাড়তে বাড়তে এখন আবার ২৪ ঘণ্টা হয়েছে। তাই ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাস হবে ২৯ দিনে। এখন তার আগে চলুন জেনে নিই ফেব্রুয়ারির ইতিহাস।

 

 

 

গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডারের আগে ছিল জুলিয়ান ক্যালেন্ডার। জুলিয়ান ক্যালেন্ডারে ৩০৪ দিনে বছর হতো। যা প্রায় দশ মাস। কিন্তু এতে আবহাওয়া বা বৈচিত্র্যের সাথে সময় মিলতো না। একসময় রাজা পম্পিলিয়াস দেখলেন ৩০৪ দিয়েও বছর প্রকৃতির সংজ্ঞে মিলছে না। তারপর প্রায় ৭০০ খ্রিষ্টাব্দের পর বছরের সাথে আরও ৬০ দিন যোগ করেন। কিন্তু তাতেও কাজ হলো না। যার ফলে ঋতু থেকে ৩ মাস এগিয়ে গেল বছর।

  •  

সেই সমস্যা সমাধানে বছরের আগে আরও দুটি মাস যোগ করা হলো। যদিও আগে মার্চ মাস দিয়ে বছর গণনা শুরু হতো। পরবর্তীতে দুটি মাস যুক্ত হওয়ায় জানুয়ারি মাস দিয়ে বছর শুরু হয়। তারপর আগে ফেব্রুয়ারি মাস। রোমান দেবতা ফেব্রুসের নামানুসারে ফেব্রুয়ারি মাসের জন্ম হয়। এরপর চলে আসি ২০২৪ সালে। এই সালটা একটা চমক। কেননা ২০২৪ সালটি হলো অধিবর্ষ। অর্থাৎ ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আমরা একটা দিন আমরা বেশি পেতে যাচ্ছি। যার কারণে এই মাসটি হবে ২৮ দিনের পরিবর্তে ২৯ দিনে।

যে কারণে অধিবর্ষ হয়ঃ

পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে ৩৬৫ দিনে। আসলে শুধু ৩৬৫ দিন নয়। এর সঙ্গে আছে আরও ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড। আমরা এটাকে ৩৬৫ দিনের সাথে আরো ৬ ঘণ্টা ধরি। এভাবে প্রতিবছর যদি ৬ ঘণ্টা করে বাড়ে, তাহলে ৪ বছরে ২৪ ঘন্টা বাড়ে। অর্থাৎ ১ দিনের সমান। এই দিনটি গণনা করা হয় চার বছর পরপর। যে বছরে এই অতিরিক্ত ২৪ ঘন্টাকে হিসাব করা হয়, সেই বছরটাকে বলি লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ। ২০২০ সাল ছিল অধিবর্ষ। এভাবে বছরে ৬ ঘণ্টা করে বাড়তে বাড়তে ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে ২৪ ঘন্টা বৃদ্ধি পেয়ে ২০২০ সাল হয়েছে অধিবর্ষ। মজার ব্যাপার হচ্ছে উপরের নিয়মে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাস ২৯ দিনে হওয়ায় ২০২৪ সালটি অধিবর্ষ।

অধিবর্ষে ২৮ দিনের পরিবর্তে ১ দিন বেড়ে ফেব্রুয়ারি মাস হয় ২৯ দিনে। যেহেতু ৪ বছর পর পর অধিবর্ষ হয়, তাই যেকোনো সালকে ৪ দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা গেলে সেই সালটি হয় অধিবর্ষ। যেমনঃ ২০২৪-কে ৪ দিয়ে নিঃশেষে ভাগ করা যায়। সুতরাং ২০২৪ সাল অধিবর্ষ বা লিপ ইয়ার। একইভাবে এভাবে ভাগ করে পরবর্তী সালগুলোও অধিবর্ষ কিনা সেটা বের করা যাবে। আর সেই হিসাব অনুসারে, ২১০০ সালও অধিবর্ষ হওয়ার কথা। কারণ ২১০০ ÷ ৪ = ৫২৫। কিন্তু ২১০০ সাল অধিবর্ষ হবে না।

এর কারণ কি?

 

আমরা আগে বলেছিলাম, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ডে। কিন্তু আমরা সেটাকে হিসেবের সুবিধার জন্য ধরেছি ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা। অর্থাৎ ১১ মিনিট ১৩ সেকেন্ড বেশি হিসেব করছি। এই কারণেই কিছু সাল ৪ দিয়ে বিভাজ্য হলেও, সেগুলো অধিবর্ষ হয় না। তাহলে কীভাবে আমরা বুঝবো সালটি অধিবর্ষ কিনা? এই সমস্যা সমাধানে প্রথমে সালটিকে ৪ দিয়ে ভাগ করে দেখতে হবে ৪ দিয়ে বিভাজ্য কিনা। যদি ৪ দিয়ে বিভাজ্য হয়, তাহলে ভাগ দিতে হবে ১০০ দিয়ে। এবারেও যদি বিভাজ্য হয়, তাহলে শেষে ভাগ দিতে হবে ৪০০ দিয়ে। এভাবে সবশেষে বিভাজ্য হলে ধরে নিতে হবে বছরটি অধিবর্ষ। এখন এবার আসি ২১০০ সাল অধিবর্ষ হবে না কেনো। কারণ সালটি ৪ ও ১০০ দিয়ে বিভাজ্য হলেও ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য নয়। আবার ২০০০ সাল ৪, ১০০ ও ৪০০ দিয়ে বিভাজ্য, তাই ওই সালটি ছিল অধিবর্ষ।

তবে এ নিয়ম কিন্তু শুধু শতাব্দীর সালগুলো বের করার জন্য খ্রিস্টাব্দের জন্য নয়। সাধারণ সালের ক্ষেত্রে (২০২৪) অধিবর্ষ বের করতে উক্ত সালকে শুধু ৪ দিয়ে ভাগ করলেই চলবে।

 

অধিবর্ষ কেন গুরুত্বপূর্ণ?

অধিবর্ষ পালন না করা হলে পৃথিবীতে সময়ের হিসাব ঠিক থাকত না। পৃথিবী সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে আসতে ঠিক ৩৬৫.২৫ দিন নেয় না, কিছুটা কম সময় নেয়। তাই চার বছর পর পর বছরে একদিন বেশি হিসাব করলে প্রতি চারশ বছরে তিনদিন বেশি হয়ে যায়। এভাবে প্রতি বছরে প্রায় ৬ ঘণ্টা করে বাড়তে থাকবে। এতে পৃথিবীর ঋতুবৈচিত্র বদলে যাবে। অর্থাৎ যখন গরম হওয়ার কথা, তখন না এসে গরম আসবে তার অনেক পরে।

 

অধিবর্ষের ইতিহাসঃ

 

৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রাচীন রোমান সম্রাট জুলিয়াস সিজার জুলিয়ান ক্যালেন্ডার প্রবর্তন করেন। এই ক্যালেন্ডার অনুসারে ৩৬৫ দিনে বছর হলেও অধিবর্ষের হিসাব ঠিক ছিল না। আসলে জুলিয়াস সিজার অধিবর্ষের ব্যাপারটা জানলেও প্রতি একশ বছরে যে অধিবর্ষ হয় না তা জানতেন না। এই সমস্যার সমাধান করেন পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি। তিনি ১৫৮২ সালে  জুলিয়ান ক্যালেন্ডারকে আরেকটু উন্নত করে গ্রেগরি ক্যালেন্ডার চালু করেন। মূলত প্রতি ১০০ বছরের অধিবর্ষের হিসাব ঠিক করেন তিনি। বাকি সব ছিল জুলিয়াস ক্যালেন্ডারের অনুরূপ।

 

পোপ গ্রেগরি প্রতি ১০০ বছরে ১ দিন কমিয়ে আবার প্রতি ৪০০ বছরে ১ দিন বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। এজন্যই অধিবর্ষ বের করার সময় ১০০ ও ৪০০ দিয়ে ভাগ করা হয়। অনেক বছর গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার শুধু ইতালি ও স্পেনে ব্যবহৃত হতো। এরপর ১৭৫২ সালে গ্রেট ব্রিটেন গ্রেগরি ক্যালেন্ডার চালু করে।

 

অধিবর্ষে জন্মদিনঃ

অধিবর্ষে কারো জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা কেমন? যদি সেটা জানতে চাওয়া হয় তাহলে হিসাবটা হবে অনেকটা এমন যে- যেহেতু অধিবর্ষ আসে ৪ বছর পর পর। সেহেতু প্রথম ৩ বছরে ৩৬৫ দিন কিন্তু চতুর্থ বছরে হবে ৩৬৬ দিন কারণ অধিবর্ষের জন্য একদিন বেড়ে যায়। তাহলে মোট দিন সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪৬১ দিন। অর্থাৎ তাহলে অধিবর্ষে কারো জন্মদিন হওয়ার সম্ভাবনা হয় ১৪৬১ জনের ভিতরে প্রতি একজনের।

আশা করি লিপ ইয়ার নিয়ে আপনাদের মাঝে গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলটি তুলে ধরতে পেরেছি। পাঠক বিডির সাথে থাকুন, ভালো থাকুন। ধন্যবাদ।

Scroll to Top